সুন্দর মুখ মানেই দাগহীন কোমল মসৃণ ত্বক। সেই মুখশ্রীতে অনেক সময় আমাদের কিছু ভুলের কারণে বা নানাবিধ কারণে সৃষ্টি হয় অনাকাঙ্ক্ষিত দাগ। এই দাগ সৌন্দর্যহানি ও বিব্রতকর। এমনই একটি সাধারণ দাগ হলো মেছতা। মেছতাকে মেলাজমা, ক্লোয়াজমা ফেসি বলা হয়। জরিপে দেখা গেছে, তুলনামূলকভাবে মেয়েদের মেছতা বেশি হয় এবং রিপ্রোডাকটিভ এজেই বেশি দেখা দেয়। নারী-পুরুষের অনুপাত ৯:১। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মেছতার প্রকোপ বেশি।
মেছতা একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এটি সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। সাধারণত বাদামি বর্ণের হলেও ত্বকের গভীরতা, ত্বকের ধরন অনুযায়ী রঙের হালকা তারতম্য হতে পারে। ত্বকের স্তর ও মুখমণ্ডলের বিভিন্ন অংশ, পরিসরের ওপর ভিত্তি করে মেছতা শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। গভীরতা অনুযায়ী এপিডার্মাল, ডার্মাল ও মিক্সড মেলাজমা নামকরণ করা হয়েছে। সেন্ট্রোফেসিয়াল মেলাজমা থুতনি, কপাল ও নাকে হয়। এ ধরনের মেলাজমার হার বেশি। ৬ ভাগ মেলাজমাই সেন্ট্রোফেসিয়াল। ম্যালার মেলাজমা দুই চিবুকে সমানভাবে আর ম্যান্ডিবুলার টাইপ চোয়ালের নিচে হয়। মেছতা মুখ ছাড়াও হঠাৎ করে দুই বাহুতে হতে পারে। তবে এর হার খুবই কম। মেলানোসাইট সেল দিয়ে তৈরি বাড়তি মেলানিনের কারণেই সৃষ্টি হয় মেছতার। এর অসংখ্য কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বংশগত কারণটি প্রধান। কিছু কিছু রোগেও মেছতা বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ হাইপোথাইরয়েডিজম। গর্ভাবস্থায় মেছতার হঠাৎ আবির্ভাব হয় বলে একে মাস্ক অব প্রেগনেন্সি বলা হয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ নারী জন্মনিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা হিসেবে বেছে নেন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি। বার্থ কন্ট্রোল পিল দিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। তবে অন্যদিকে আক্রান্ত হচ্ছেন মেছতায়। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির মতো পোস্ট হরমোনাল থেরাপিও মেছতার একটি কারণ। সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে, চুলার তাপ মেলানিন তৈরির উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য যেসব প্রসাধনী ব্যবহার করা হয় অথবা হালকা মেছতা মেকআপ দিয়ে ঢাকার জন্য যেসব প্রচেষ্টা চালানো হয়, সেসব প্রসাধনীর ক্ষতিকর কেমিক্যাল, ফ্রেগ্রনেন্স মেছতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু চোখে দেখেই মেছতার ডায়াগনোসিস সম্ভব। এ ছাড়া সাহায্য নেওয়া যায় উড্স ল্যাম্পের। উড্স ল্যাম্পে এপিডার্মাল ও ডার্মাল-এর পার্থক্য স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এপিডার্মাল উড্স ল্যাম্পে গাঢ় ও ডার্মাল হালকা দেখায়। প্রেগনেন্সিতে মেছতার আবির্ভাব হলেও শিশু জন্মানোর কয়েক মাস পর মেছতা নিজে থেকেই চলে যায়। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বা হরমোনাল থেরাপির কারণে এগুলোও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। সে ক্ষেত্রে বেছে নিতে হবে জন্মনিয়ন্ত্রণের অন্যান্য পদ্ধতি।
এক সময় মেছতার চিকিৎসায় স্কিন লাইটেনিং ক্রিম লোশন, সেরাম ব্যবহার করা হতো। এদের মধ্যে দুই ভাগ বা চার ভাগ হাইড্রোকুইননই বেশি জনপ্রিয়। হাইড্রোকুইননের সঙ্গে ট্রেটিনয়িক এসিড (০.২৫ ভাগ বা ০.০৫ ভাগ), হাইড্রোকর্টিসন যোগ করা হলে চমৎকার ফল পাওয়া যায়। তবে গর্ভাবস্থায় ট্রেটিনয়িক এসিড ব্যবহার নিষিদ্ধ। একসময় এজোলিক এসিডের ব্যবহার করা হতো। সময়ের সঙ্গে যুগের চাহিদা অনুযায়ী মেছতার অনেক আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। ইদানীং মাইক্রোডার্মাব্রাসন ও ডায়ামন্ড পিল বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কখনো কখনো মাইক্রোডার্মাব্রাসনের সঙ্গে বা শুধু একা কেমিকেল পিল-এর পরামর্শ দেন ডার্মাটোলজিস্টরা। ৩০ ভাগ থেকে ৭০ ভাগ গ্লাইকোলিক এসিড বেশি ব্যবহৃত হয়। এসব পদ্ধতি কয়েক সেশন লাগে। পিআরপি, মাইক্রোনিডলিং লেজার-এর মতো আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও শুরু হয়েছে। এসব চিকিৎসার সঙ্গে অবশ্যই ৩০ বা ৫০ এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। কারণ কোনো চিকিৎসাই কার্যকরী হবে না যদি আপনি নির্দেশাবলি মেনে না চলেন।
মেছতা খুব সাধারণ একটি চর্মরোগ হলেও ডার্মাটোলজিস্টদের কাছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, অনেক রোগীই এই চিকিৎসায় সন্তুষ্ট নয়। এর অন্যতম কারণ হলো ডার্মাল বা গভীর মেলাজমা চিকিৎসার সাহায্যে হালকা হলেও খুব কম ক্ষেত্রেই পুরোপুরি সারে। সে ক্ষেত্রে হালকা হওয়াকেই উন্নতি বলে ধরে নিতে হবে। হতাশার কিছু নেই। মেছতার হালকা লক্ষণ দেখা মাত্রই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। কারণ, সঠিক চিকিৎসার অভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেছতা বাড়তে থাকে। দীর্ঘস্থায়ী হলে হয়তো কোনো চিকিৎসাই কার্যকর হয় না।
লেখক : ডার্মাটোলজিস্ট, শিওর সেল মেডিকেল (বাংলাদেশ) লি.